উত্তম_মূল্যায়ন।
#উত্তম_মূল্যায়ন।
'অমানুষ' ছবির পর বোম্বাইতে উত্তমকুমারের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।তখন হিন্দি ছবির অনেক প্রযোজক ও পরিচালকরা উত্তমকুমারকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন।এখন কাজের সুবাদে যেসব পরিচালকরা উত্তমকুমারকে নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন।এখন কাজের সুবাদে যেসব পরিচালকরা উত্তমের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এখানে রয়েছে তাঁদের স্মৃতিচারণ, তাঁদের চোখে অভিনেতা উত্তমের মূল্যায়ন।
ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস লিখতে গেলে উত্তমকুমারের কথা কেউ বাদ দিতে পারবে না।হিন্দি ছবির জগতে উত্তমের প্রবেশ অস্বস্তি ঘটিয়েছিল ওঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের।হিন্দি ছবিতে উনি যে সাফল্য পাননি, সেটা কিন্তু আসলে হিন্দি ছবিরই লোকসান।।
উত্তমকে নিয়ে হিন্দি ও বাংলায় দুটি ছবি করেন শক্তি সামন্ত।ওঁর কথা মনে করে শক্তি বললেন,'উত্তম খুব বড় শিল্পী।ওঁর অকালমৃত্যু বাংলা ছবির পক্ষে খুব বড় আঘাত।কাজ মন দিয়ে করতেন বলে ওঁর সঙ্গে কাজ করে সুখ ছিল।সেটের মধ্যে কোন বন্ধুবান্ধব বা অতিথিদের সঙ্গে কথা বলতেন না।নেহাৎ প্রয়োজন হলে সেটের বাইরে গিয়ে কথা বলতেন।শুটিংয়ে যেন ব্যাঘাত না হয়,এই ছিল ওঁর মনোভাব।বোম্বাইতে, উত্তমকে নিয়ে সমস্যা হলো মারপিটের দৃশ্যে।উনি মারবার ভান করতেও পারতেন না।বোঝাতাম,'উত্তম কেবল মারবার ভঙ্গি করো,মারতে হবে না।ঘুষিটা নাকের কাছে গেলেই অন্য অভিনেতা ঘুষি খাবার ভান করবে,উত্তম কিন্তু সত্যি সত্যিই ঘুষি মেরে অন্য শিল্পীকে আহত করতেন।
'একবার তো উত্তমকে নিয়ে বোম্বাইতে শুটিং চলছে।আমার 'দেশপ্রেমী'-তেও উত্তম কাজ করছে অমিতাভের সঙ্গে।অমিতের আঙুলে প্লাস্টার দেখে জানতে চাইলাম কী ব্যাপার?হেসে অমিত বলল,'উত্তমজীর সঙ্গে ফাইট সিন ছিল।উনি বাঁশ দিয়ে মেরে আমার আঙুল জখম করে দিয়েছে।' অমিত অবশ্য তা নিয়ে রাগ করেনি।হাসতে হাসতেই ঘটনাটা বলে গেল।এই একটা সমস্যা ছাড়া উত্তমকে নিয়ে কাজ করার কোনও সমস্যা ছিল না।
শক্তি সামন্ত জানালেন,'না না,খুব ভালো গানের গলা ছিল ওঁর।গান জানতেন, ভালও বাসতেন।'তখন উত্তমকে ছাড়া আর কটা বাংলা ছবি তৈরি হতো!অবশ্য শেষ দিকে ওর ছবি ফ্লপ হতে শুরু করায় ইন্ডাস্ট্রি মার খেতে শুরু করে।হিন্দি ছবিতে যেমন নায়কদের মারপিট একঘেয়ে হয়ে আসছে,বাংলা ছবিতেও উত্তমকে দিয়ে একই রকম দৃশ্য বারবার অভিনয় করানো হচ্ছিল।তবে ওঁর ছবি শেষদিকে ফ্লপ হতে শুরু করলেও ওঁর মৃত্যুতে বাংলা চলচ্চিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।ওঁর কাজে নিয়মানুবর্তিতা ছিল, আন্তরিকতাও ছিল।
উত্তমের আরেকটা গুণ ছিল যে উনি অন্যের নিন্দে করতেন না।ঠাট্টা করেও নয়।বাজে গল্পগুজবও করতেন না।'
বাসু ভট্টাচার্যের 'গৃহপ্রবেশ' এ কাজ করেন উত্তম।মানে, কাজ করা শুরু করেন।তারপর অন্য নায়ক নেন বাসু ভট্টাচার্য্য।বললেন,'কিন্তু এখন ওঁর অভাবটা অনুভব করি।কলেজজীবন থেকেই ওঁর ফ্যান আমি।তাই কাজ করতে চেয়েছিলাম।নিজে ছবির জগতে আসার পর দেখাসাক্ষাৎ হতো।ওঁকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছেটাও মনের মধ্যে দানা বাঁধছিল।অপেক্ষা করছিলাম উপযুক্ত গল্পের জন্য।'গৃহপ্রবেশ'এর জন্য উত্তমকেই আদর্শ অভিনেতা মনে হলো।আগেই সারিকা ও শর্মিলাকে সই করিয়েছী।
অন্য ছবির কাজে বোম্বাইতে এসে উত্তম রয়েছে সান-এন্ড-সান হোটেলে।ফোন করে জানতে চাইলাম সন্ধ্যেয় উনি খালি আছেন কিনা।ওঁর অভ্যেস তো জানি।আমাকে চলে আসতে বললেন।গিয়ে বললাম, ওঁকে ছবিতে নিতে চাই।আরও বললাম, কাজ শুরুর আগে পারস্পরিক বোঝাপড়া দরকার।পরস্পরের ভালোমন্দ দিকগুলো জেনে রাখা ভালো।
তারপর উনি পারিশ্রমিক ও চিত্রনাট্য এর কথা তুললেন।টাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলিনি।কিন্তু চিত্রনাট্য প্রসঙ্গে বললাম,'আমি চিত্রনাট্য দেখাব না আপনাকে।আপনি কিন্তু আমার ছবিতে স্টার নন।' উত্তম বললেন,'আপনি আমাকে স্টার মনে করেন না?'
বললাম,'আমার ছবিতে নয়।আপনি বড় শিল্পী বলেই আপনাকে নিচ্ছি।আপনি ছবিতে আমার কর্মচারী।গল্প বলে দিচ্ছি।সময়মতো ডায়লগ পেয়ে যাবেন।কিন্তু চিত্রনাট্য দেব না।'
উত্তম রাজি হয়ে গেলেন।আমার আরও শর্ত ছিল।বললাম,' ডেট বা পারিশ্রমিক নিয়ে আপনার সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলবো না।আমার সেক্রেটারি নেই।আমি সোজাসুজি আপনার সঙ্গে কথা বলব।আগে থেকে ডেট ঠিক করে নিন।সময়মতো টাকা পাবেন।' উত্তম বললেন,'আমার ঘর যেন সান-অ্যান্ড-স্যান্ড-এ বুক করা হয়।-এত নম্বর সুট চাই।' বললাম, সুইট নাম্বার আপনি হোটেলের সঙ্গে ঠিক করে নেবেন।আমার কিছু করার নেই।'
কিন্তু এর আগেও তো বাসু উত্তমকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন?বললেন,'ঠিক।কিন্তু উনি সুপ্রিয়াকে নায়িকা রাখতে জেদ করেন।রাজি হইনি।তাই সে ছবি হলো না।যাইহোক, এ ছবির আয়োজন শুরু করলাম।প্রথম দফায় শুটিং শুরুর আগের দিন বোম্বাই আসতে বললাম।পরদিন ভোরে শুটিং।উত্তমের সেক্রেটারি বললেন, ঠিক আছে।পরদিন সকালে উত্তমের ফোন এলো কলকাতা থেকে।ওঁর শুটিং একসপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ।কিন্তু কেন? বললেন,'মা অসুস্থ।হাসপাতালে ভর্তি করেছি।' বললাম,' ঠিক আছে। শর্মিলা ও সারিকাকে নিয়ে শুটিং চালিয়ে নেব।মার অসুস্থতার গুরুত্ব অনেক।
এক সপ্তাহ পরে উত্তম এলেন।শুটিং শুরু হলো।না,উত্তম মননশীল অভিনেতা নন।কিন্তু ভেতরে অভিনয়ের একটা নিজস্ব বোধ ছিল।যখন রোলটা বোঝাচ্ছিলাম,উত্তম যেন চোখ দিয়ে শুনছিলেন।এ একটা আশ্চর্য গুণ।
'উত্তমের চোখ ভালো নয়,মুখশ্রী ভালো নয়,কপাল বিশ্রী।সবই বিশ্রী।তবু সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য শিল্পী ব্যক্তিত্ব।অভিনেতা হিসেবে নিখুঁত।অসাধারণ প্রতিভা।
সেটে বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলতেন না।
এরপরে উত্তম গিয়ে শুটিং শুরু করেন। একদিন।উত্তম মেকআপ নিয়ে ফ্লোরে পরিচালকের ডাকের অপেক্ষা করছেন। এমন সময় পরিচালক আলো সরকারের ভাই অসীম সরকার এসে উত্তমকে কাছে ডেকে বললেন "মা কেমন আছে?" উত্তম তখন বললেন "রাখতো গুল মেরেছি", কথাটা পরিচালক বাসুর কানে গেল। তিনি সারাদিন অন্য সবার শট নিলেও উত্তমবাবু কে একবারও ডাকলেন না বা কথা বললেন না। রাত আটটায় উত্তম বললেন "আমার যদি আজ শট না থাকে তবে আমি চলে যাই", কিন্ত বাসু তখন বললেন "আপনার শট নেব না আজ তবে আপনি এখানেই থাকুন। বলার মধ্যে রুক্ষভাব টের পেলেন উত্তমকুমার।।
এরপর বাসু উত্তমকে অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেন। "ছি ছি মা'র নামে মিথ্যে কথা"। এখন বাসু বলেন, তার একটি কথারো প্রত্যুত্তর দেন নি উত্তম। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। এখন সেসব স্মৃতি মনে আসলে বাসুর অনুশোচনা হয়।
ততদিনে উত্তম মুম্বাইতে এক সেক্রেটারিও পেয়ে গেছেন। যাই হোক বাসু উত্তমকে বলেন, কোলকাতায় গিয়ে "গৃহপ্রবেশ" এ কাজ না করার চিঠি পাঠিয়ে দিন। কিন্তু উত্তম কোলকাতায় গিয়ে এক উকিলের নোটিশ পাঠালেন। নিশ্চয়ই বন্ধুবান্ধবেরা কেউ বুদ্ধি দিচ্ছিল। উত্তম আবার কাউকে কাউকে এমনো বললেন "ছয় সাত রিল আমাকে নিয়ে তোলা হয়ে গেছে এখন আর আমাকে বাদ দেওয়ার জো নেই"।তখনি ঠিক করলাম উত্তমকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নেব। সঞ্জীবের সাথে কথা বললাম। সঞ্জীব বলে "আমার কথা মনে হয়নি, উত্তমকে নেওয়ার আগে?"
"কিন্তু "গৃহপ্রবেশ" ছবিতে যতখানি উত্তম কাজ করেছিলেন সেটা কেমন ছিল?" এবারে বাসুর চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। বাসু বললেন "অসাধারণ কাজ করেছিলেন উত্তম, মিউজিয়ামে রেখে দেওয়ার মত সুন্দর"। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ বাসু ভট্টাচার্য আর উত্তমকুমার জুটির "গৃহপ্রবেশ", যাতে নায়িকা ছিলেন শর্মিলা আর সারিকা, তা দিনের আলোয় এলোনা, আমরা বঞ্চিত হলাম।
Comments
Post a Comment